আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি রনজিত ও তার পরিবারের দুর্নীতির মহোৎসব

দুর্নীতিকে আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার ফলে যশোর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) রনজিত কুমার রায় ও তার পরিবারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। এই ১৬ বছরে রনজিত ও তার পরিবারের ১৩৩টি ব্যাংক একাউন্টে লেনদেন হয়েছে ১৮৩ কোটি ১২ লাখ ৬৬ হাজার ৩৭ টাকা।
দুদকের তিন সদস্যের তদন্ত টিম রনজিত কুমার রায় ও তার পরিবারের চার সদস্যের দুর্নীতি তদন্ত করতে গিয়ে রীতিমতো নিজেরা বোকা বনে যাবার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এটি যেনো দুর্নীতির এক মহোৎসব চিত্র।
দুদকের একজন কর্মকর্তা বাসস’র সঙ্গে আলাপকালে বিস্ময়ে বলেন, এ যেন রূপকথার এক গল্পের মতো আওয়ামী দুঃশাসন। দুর্নীতি হয় জানি, কিন্তু এমন দুর্নীতি অবিশ্বাস্য! মাত্র ১৬ বছরে এরা বিপুল সম্পদের মালিক, নগদ টাকা, ব্যাংকে লেনদেন, ঢাকা-যশোরে মূল্যবান প্লট ও ফ্ল্যাটের মালিক।
দুদক টিম যশোরে তদন্ত চলাকালে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রনজিত কুমারের কলকাতার ক্রিসেন্ট লেকে বাড়ি রয়েছে। জুলাই বিল্পবের পর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রনজিত সেখানে পলাতক রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুদক তদন্ত টিমের একজন সদস্য বলেন, মামলা রুজুর পর আরো তদন্ত হবে। সেখানে বিষয়গুলো বিশদভাবে উঠে আসবে।
তদন্ত টিমের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, রনজিত কুমারের নামে যশোরের বাঘারপাড়ে ও জেলার অন্যান্য স্থানে প্রায় ৮০০ শতক জমির কাগজ পত্র সংগ্রহ করেছে। এছাড়াও দুইটি খেজুর বাগান ও গৃহ সম্পদ রয়েছে। তার দুই সন্তানের নামে সম্পদ রয়েছে ৩০০ শতক। স্ত্রীর নামে ঢাকার মিরপুরে পাঁচতলা ভবন রয়েছে। মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৫০ লাখ টাকা। এছাড়া যশোরে তিন তলা বাড়ি রয়েছে দুইটি। রনজিতের ১০কাঠার বেশি একটি রাজউকের বরাদ্দ পাওয়া প্লট রয়েছে পুর্বাচলে ২০৬ নং রোডে। যার মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৩৫ লাখ টাকা। অথচ বর্তমান বাজার মূল্যে এই প্লটের দাম অন্তত ১৫ কোটি টাকা। দুদক তাদের অন্যান্য সম্পদের মূল্য নির্ধারণ বিষয়গুলো তদন্ত করছে।
তদন্ত টিমের একজন সদস্য জানান, রনজিত কুমার রায় ২০০৬-২০০৭ কর বর্ষে প্রথম আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন। এর আগে তার কোন আয়কর রির্টান ছিলো না। উক্ত কর বর্ষে তার মাত্র ১ লাখ ২১ হাজার টাকার নিট সম্পদ ছিল। ওই সময়ে তার স্ত্রী ও দুই সন্তানের কোন সম্পদ ছিল না। কিন্তু বর্তমানে তার নিজ নামে, স্ত্রী ও দুই সন্তানের নামে ব্যাংক লেনদেনের বাইরেও মোট ১৫ কোটি ৬৪ লাখ ৩ হাজার ২৪ টাকা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ পাওয়া গেছে।
তিনি জানান, তাদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে খোলা মোট ১৩৩টি ব্যাংক হিসাবে ১৮৩ কোটি ১২ লাখ ৬৬ হাজার ৩৭/- টাকা আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সন্দেহজনক লেনদেন পাওয়া যায়।
দুদকের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হক, সহকারি পারচালক মো. সাজিদ-উর-রোমান এবং উপ-সহকারী পরিচালক মো. জুয়েল রানা প্রায় এক মাস ধরে তদন্ত করে এসব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন।
জ্ঞাত আয় বর্হিভুত সম্পদে অর্জনের মামলায় আসামিরা হচ্ছেন- রনজিত কুমার রায় (সাবেক সংসদ সদস্য, যশোর-৪), রনজিত কুমার রায়ের স্ত্রী নিয়তি রাণী রায়, পুত্র রাজিব কুমার রায় ও সজিব কুমার রায়, রাজিবের স্ত্রী রিশিতা সাহা এবং সজিবের স্ত্রী অনিন্দিতা মালাকার পিউ।
সূত্র জানান, রনজিত কুমার রায় ২০০৯ সালের নির্বাচনে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর থেকে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে নিজ নামে ৬ কোটি ১২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯৩ টাকা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। তার নিজ ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবসমূহে মোট ৩৯ কোটি ৪৮ লাখ ৪৫ হাজার ৫৬৪ টাকা সন্দেহজনক লেনদেনের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারা, ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২), মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
নিয়তি রাণী রায় স্বামীর যোগসাজসে তার স্বামী সাবেক সংসদ সদস্য রনজিত কুমার রায়ের ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে নিজ নামে ১ কোটি ৯৯ লাখ ১৮ হাজার টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং তার নিজ ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাব সমূহে মোট ৮ কোটি ৮০ লাখ ৫০ হাজার ১০৬/-টাকা সন্দেহজনক লেনদেনের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারা, ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২), মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ধারা তৎসহ দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
অপরদিকে, রনজিত কুমার রায় ও তার স্ত্রী নিয়তি রাণী রায় এবং তাদের পুত্র রাজিব কুমার রায় মৎস্যখাতেও আয় দেখিয়ে কর রেয়াত নিয়েছিলেন। এইখাতে রনজিত ২০১৫-২০১৬ কর বর্ষে ১ কোটি টাকা, ২০১৬-২০১৭ কর বর্ষে ৯০ লাখ টাকা এবং ২০১৭-২০১৮ কর বর্ষে ৯০ লাখ টাকা আয় দেখিয়েছেন। পুত্র রাজিব কুমার রায় ২০১৭-২০১৮ কর বর্ষ থেকে ২০২৪-২০২৫ কর বর্ষে ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। স্ত্রী নিয়তি রাণী রায় ২০১৩-২০১৪ কর বর্ষে ও ২০১৫-২০১৬ কর বর্ষে ১ কোটি ৫১ লাখ ৮২ হাজার টাকা।
রনজিতের পুত্রদ্বয় রাজিব কুমার রায় এবং সজিব কুমার রায় প্রথমে আয়করের রির্টান দাখিল করেন ২০১৭-২০১৮ কর বর্ষে। তখন রাজিব তার আয় দেখিয়েছেন ৮৮ লাখ ৭৮ হাজার ৬৯ টাকা। ২০২৪-২০২৫ কর বর্ষে তিনি আয় দেখিয়েছেন ৪ কোটি ৩৩ লাখ ১৩ হাজার ৯৫৭ টাকা। অপরদিকে ডাক্তার সজিব কুমার রায় নিজের আয় দেখিয়েছেন ২ কোটি ৮০ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ টাকা। ২০২৪-২০২৫ কর বর্ষে তিনি আয় দেখিয়েছেন ৪ কোটি ৪০ লাখ ৭৩ হাজার ৩৮৩ টাকা।
রাজিব কুমার রায় পিতার যোগসাজসে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে নিজ নামে ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। তার নিজ ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবসমূহে মোট ১৬২ কোটি ৩৪ লাখ ৪৮ হাজার টাকা সন্দেহজনক লেনদেনের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারা, ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২), মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২) ধারা তৎসহ দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। তার নামে ব্যাংক একাউন্ট রয়েছে ৪০টি।
তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নিয়তি ট্রেডার্স-এর নামে একাউন্ট রয়েছে ছয়টি, স্ত্রী রিশিতা সাহার নামে একাউন্ট রয়েছে ২০টি এসব একাউন্টে ১৬২ কোটি ৩৪ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে।
অনুসন্ধানকালে মোট ২ কোটি ৩ লাখ ৯৪ হাজার টাকার স্থাবর ২ কোটি ৬৬ লাখ ৫৪ হাজার ৪১৮ টাকার অস্থাবর সম্পদ পাওয়া যায়। ফলে তার নামে প্রাপ্ত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মোট পরিমাণ ৪ কোটি ৭০ লাখ ৪৮ হাজার ৪১৮ টাকা। তার নামে ঋণ আছে ৫০ লাখ ১০ হাজার ৮৬১/- টাকা। অর্থাৎ তার নিট স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৪ কোটি ২০ লাখ ৩৭ হাজার ৫৫৭ টাকা। উক্ত সম্পদ অর্জনে তার ৬০ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৬ টাকার গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায়। ফলে তিনি ৩ কোটি ৬০ লাখ ১ হাজার ৬৮১ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনপূর্বক উহা ভোগ দখলে রেখে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
রাজিবের ৪০টি ব্যাংক হিসাবের সন্ধান পেয়েছে দুদক টিম। উক্ত ব্যাংক হিসাবে তিনি ২০ কোটি ৪৩ লাখ ২৯ হাজার ৩১৩ টাকা জমা করেছেন। এর মধ্যে ১৯ কোটি ৪৯ লাখ ৭৮ হাজার ৮০৭ টাকা উত্তোলন করেছেন। তার মালিকানাধীন নিয়তি ট্রেডার্স-এর মোট ছয়টি ব্যাংক হিসাব আছে। উক্ত ব্যাংক হিসাবসমূহে তিনি ২৭ কোটি ৪১ লাখ ১৫ হাজার ৭৪৪ টাকা জমা করেছেন এবং ২৭ কোটি ৪২ লাখ ৬ হাজার ৭৭ টাকা উত্তোলন করেছেন। তার স্ত্রী রিশিতা সাহা একজন গৃহিনী। তিনি তার স্বামীর আয়ের উপর নির্ভরশীল। রাজিব কুমার রায়ের স্ত্রী রিশিতা সাহার নামে মোট ২০টি ব্যাংক হিসাব আছে। উক্ত ব্যাংক হিসাবসমূহে তিনি ৪ কোটি ৩৮ লাখ ৬৩ হাজার ৪২২ টাকা জমা করেছেন এবং ৩ কোটি ৯৮ লাখ ৫৫ হাজার ৪৩৭ টাকা উত্তোলন করেছেন। তার মালিকানাধীন নিয়তি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল’র মোট তিনটি ব্যাংক হিসাব আছে। উক্ত ব্যাংক হিসাবসমূহে তিনি ২৯ কোটি ৬০ লাখ ৫৭ হাজার ৭৯৬ টাকা জমা করেছেন এবং ২৯ কোটি ৬০ লাখ ৪১ হাজার ৪৯২ টাকা উত্তোলন করেছেন। রাজিব কুমার রায় নিজ নাম, তার স্ত্রীর নামে, তার মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ৬৯টি বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবসমূহে মোট ৮১ কোটি ৮৩ লাখ ৬৬ হাজার ২৭৫ টাকা জমা ও মোট ৮০ কোটি ৫০ লাখ ৮১ হাজার ৮১৩ টাকা উত্তোলন করেছেন। ফলে তিনি ব্যাংক হিসাবসমূহে মোট ১৬২ কোটি ৩৪ লাখ ৪৮হাজার ৮৮ টাকা লেনদেন করেছেন। তার উপরোক্ত লেনদেন সন্দেহজনক। এভাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের মাধ্যমে তিনি তার অপরাধলব্ধ অবৈধ অর্থ জ্ঞাতসারে হস্তান্তর ও স্থানান্তর করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। অর্থাৎ তিনি তার পিতা রনজিত কুমার রায়ের ক্ষমতার অপব্যবহার পূর্বক ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ তার নামীয় উল্লিখিত হিসাবসমূহে লেনদেন করেছেন। ফলে বর্ণিত অপরাধ করায় রাজিব কুমার রায়, রনজিত কুমার রায়, নিয়তি রায় ও সজিব কুমার রায়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারা, ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২), মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২) ধারা তৎসহ দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন মর্মে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় মামলা রজু হয়েছে।
দুদক টিম জানান, রনজিতের আরেক ছেলে সজিব রায়ের ১২টি একাউন্টে প্রায় ৭ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। তিনি পিতার ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করেছেন। সজিবের স্ত্রী অনিন্দিতা মালাকার পিউ’র একাউন্ট রয়েছে ছয়টি। এসব একাউন্টে প্রায় ২ কোটে টাকা লেনদেন করা হয়েছে। সজিব কুমার রায় দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারা, ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২), মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ধারা তৎসহ দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
তাদের নামে অর্জিত উপরে বর্ণিত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদসমূহ যাতে বিক্রি বা হস্তান্তর না করতে পারে সে জন্য ফ্রিজ এবং অবরুদ্ধ করার জন্য কমিশন থেকে অনুমোদন করা হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে আদালতের নির্দেশনা চাওয়া হবে বলে মামলার তদন্ত টিম সূত্র জানান।