আন্তর্জাতিক

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা যে কারণে ভয়ের

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার মাত্র দুই মাস পরই ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিল সেটি কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে। সাত দশকের বেশি সময় ধরে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু কাশ্মীর অঞ্চল। গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরে বন্দুকধারীদের গুলিতে ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ফের আলোচনায় এসেছে এই অঞ্চলটি।

পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই ভূখণ্ড নিয়ে দুটি যুদ্ধ করেছে। দুই দেশই এই অঞ্চলের সম্পূর্ণ নিজেদের দাবি করে, তবে নিয়ন্ত্রণ করে আংশিকভাবে। চীনও এই অঞ্চলের কিছু অংশে শাসন পরিচালনা করে, এবং এটি বিশ্বের অন্যতম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সামরিকায়িত অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এর ফলে যখনই কাশ্মীরে কিছু হয় তখনই সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে যে, কী না কী হয়। এর ফলে দুই দেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোও আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়।

বাকযুদ্ধের মধ্যেই সামরিক যুদ্ধের প্রস্তুতি: ভারত কাশ্মীরে হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে। আর পাকিস্তান সেটি অস্বীকার করে আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে হামলায় জড়িতদেরকে খুঁজে এনে শাস্তি দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। এমনকি এই হামলার পেছনে যারা উসকানিদাতা ও প্রশ্রয়দাতাদেরকেও ছাড় দেবেন না বলে জানিয়েছেন। মোদির সুরে কথা বলেছেন তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহও। পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেছেন, যুদ্ধের জন্য তাদের সশস্ত্র বাহিনী সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত। পাকিস্তান সৃষ্টিতে পূর্বপুরুষরা যে আত্মত্যাগ স্বীকার করেছে, তা রক্ষা করতে যুদ্ধের জন্য তার সেনাবাহিনী প্রস্তুত আছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির। পরমাণু অস্ত্রধর দুই দেশ বড় যুদ্ধে না জড়ালেও সীমিত আকারের যুদ্ধে জড়াতে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।

দুই দেশ ইতিমধ্যে সীমান্তে দুই বার গোলাগুলির লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ইতিমধ্যে সফল ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। দেশটির আন্তর্জাতিক সীমান্তে সৈন্যসংখ্যা এবং সামরিক সরঞ্জামের মজুত বাড়িয়েছে। পাকিস্তানের রেলওয়ের স্টেশনগুলোর দায়িত্ব সশস্ত্র বাহিনীর হাতে দেওয়া হয়েছে। গত ২৬ এপ্রিল রেলওয়েমন্ত্রী হানিফ আব্বাসি জানিয়েছেন, সকল স্টেশনের নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর কাছে দেওয়া হয়েছে, যাতে প্রয়োজন অনুসারে সামরিক সরঞ্জামের সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়। এজন্য স্টেশনগুলোতে সৈনিক ডেস্ক চালু করা হয়েছে। রেলওয়ের মাধ্যমে সেনাবাহিনী ট্যাংকসহ ভারী অস্ত্রসস্ত্র পরিবহন করবে। জানা গেছে, পাকিস্তান তার যুদ্ধবিমানগুলো দক্ষিণের সামরিক ঘাঁটি থেকে সরিয়ে উত্তরের (ভারত সীমান্তের কাছে) ঘাঁটিতে এনেছে।

২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফের কনভয়ে আত্মঘাতী হামলা হয়। এতে ৪০ জন আধা সেনার মৃত্যু হয়েছিল। ঐ ঘটনার পর পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ার বালাকোটে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ শিবিরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়েছিল ভারতের বিমান বাহিনী। এবারও সেই আশঙ্কা দানা বাঁধছে। কাশ্মীরে হামলার পর আরব সাগরে বিমানবাহী রণতরী আইএনএস বিক্রান্তকে মোতায়েন করেছে ভারতীয় নৌবাহিনী। এ ছাড়া দক্ষিণ পাকিস্তানের নৌঘাঁটি তথা করাচি বন্দরের অদূরে একটি ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে ডেস্ট্রয়ার শ্রেণির জাহাজ আইএনএস সুরাট। সূত্রের খবর, পরমাণু শক্তিচালিত জোড়া ডুবোজাহাজ আইএনএস অরিহান্ত এবং আইএনএস অরিঘাটকে আরব সাগরে রওনা হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে দিল্লি।

পিছিয়ে নেই ভারতীয় বিমানবাহিনীও। ‘অপারেশন আক্রমণ’ নামের একটি মহড়া শুরু করেছে তাদের বহরে থাকা যাবতীয় যুদ্ধবিমান। রাজস্থানের মরুভূমিতে একই রকমের মহড়া চালাচ্ছে ভারতীয় স্কুল সেনার মূল যুদ্ধট্যাংক। তবে পাকিস্তানে ঢুকে প্রতিশোধ নেওয়ার আগে কূটনৈতিক প্রত্যাঘাত শুরু করেছে দিল্লি।

জলবোমাই আতঙ্কের!: ঐতিহাসিক সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি বাতিল করেছে ভারত। সিন্ধু অববাহিকার ছয়টি নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী সিন্ধু অববাহিকার রাতি (ইরাবতী), বিয়াস (বিপাশা) ও সুতলেজ (শতদ্রু) নদীর পানি ভারতের জন্য বরাদ্দ। আর সিন্ধু, ঝেলাম ও চেনাব নদীর ৮০ শতাংশ পানি পায় পাকিস্তান। তবে এই নদীগুলোর পানি বণ্টন নিয়ে আগেও দুই দেশের মাঝে বিরোধ হয়েছে। এসব নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারত কিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ও অবকাঠামো প্রকল্প করতে চাইলে তাতে বাধ সাধে পাকিস্তান। তাদের যুক্তি, এতে নদীর প্রবাহ হ্রাস এবং এটি চুক্তির লঙ্ঘন। যদিও পাকিস্তানের কৃষিকাজের প্রায় ৮০ শতাংশ ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের তিন ভাগের প্রায় এক ভাগ সিন্ধু অববাহিকার ঐ তিন নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল। গত কয়েক দশক ধরে দুই দেশই এই চুক্তি নিয়ে আইনি লড়াই করেছে। কিন্তু এবারই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো পক্ষ চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দিল, আর এটি করল ভারত। কারণ উজানের দেশ হিসেবে তারা ভৌগোলিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। তবে পানি সম্পূর্ণরূপে আটকে দেওয়া ভারতের জন্য সম্ভব নয়। কারণ এত পানি রাখার জলাধার ভারতের নেই। কিন্তু গ্রীষ্মকালে আটকে দিলে পাকিস্তানের কৃষি ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই জলবোমাই আতঙ্কের। কারণ পানি আটকে দিলে পাকিস্তান তার ক্ষতি সামাল দিতে পারবে না। তাইতো পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি হুমকি দিয়েছেন, ‘সিন্ধু নদে হয় পানি বইবে, না হয় ভারতীয়দের রক্ত।’ আর ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী সিআর পাতিল বলেছেন, সন্ত্রাসী হামলার পালটা ব্যবস্থা হিসেবে ভারত সিন্ধু নদ থেকে পাকিস্তানে এক ফোঁটা পানি প্রবাহিত হতে দেবে না। তিনি জানান, শিগগিরই নদীর প্রবাহ বন্ধ করতে ড্রেজিং কাজ সম্পন্ন হবে এবং প্রবাহ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হবে।’ বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে এই জলবোমাই দুই দেশকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাবে কি না, সেটাই আতঙ্কের বিষয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী হতে পারে: সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর মধ্যে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠাকে কেন্দ্র করে যেসব প্রশ্ন উঠেছে, তার মধ্য একটা হলো এই পরিস্থিতি প্রশমনে যুক্তরাষ্ট্র কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে কি না। কারণ অতীতে একাধিকবার কাশ্মীর ইস্যুতে মধ্যস্থতা করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন তিনি। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু এখন মার্কিন প্রেসিডেন্টের মন্তব্যে অন্য রহস্য পাওয়া যাচ্ছে। জঘন্য হামলার কড়া নিন্দা জানালেও এবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে বলতে শোনা গেল, কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের লড়াই ১০০০ বছরের। এই লড়াই আরো দীর্ঘস্থায়ী হবে। এছাড়া ঐ সীমান্তে ১৫০০ বছর ধরে উত্তেজনা তৈরি হয়ে আছে।

ট্রাম্প বলেন, দুই দেশই আমার বন্ধু। এই সমস্যার সমাধান তাদেরই করতে হবে। অর্থাৎ এককথায় ট্রাম্প স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, দিল্লি-ইসলামাবাদের মধ্যে মধ্যস্থতা করবেন না। ফলে ভবিষ্যতে যুদ্ধ বাঁধলে তিনি ‘বন্ধু’ ভারতের পাশে কতটা দাঁড়াবেন সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। তবে ট্রাম্পের এমন মন্তব্যে সমালোচনাও শুরু হয়েছে। কারণ ১৯৪৭ সালেই প্রথম ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান হয়। এর আগে দুই দেশের অস্তিত্বই ছিল না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বক্তব্যে অস্পষ্টতা থাকলেও মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান তুলসি গ্যাবার্ডের মন্তব্য কিন্তু ভারতের পুরোপুরি পক্ষে। তিনি কাশ্মীরে হামলাকে ইসলামি সন্ত্রাসীদের হামলা বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদিকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠিও পাঠিয়েছেন। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রবিও সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ভারতের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন। একই ঘোষণা দিয়েছে ইসরাইলও। হামলায় জড়িত জঙ্গিদের সঙ্গে গাজার হামাসের যোগসাজশ রয়েছে বলেও ভারতে নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

এছাড়াও পরীক্ষা করুন
Close
Back to top button